কুহক Read Count : 116

Category : Stories

Sub Category : Romance
মানুষের জীবনের এক একটা পর্বে অনুভূতি এক এক রকম ভাবে প্রকাশ পায়। যেমন উদাহরণ দিয়ে একটা গল্প লিখছি।......... 

ঋষিকা হাতের সিগারেটের শেষ হয়ে যাওয়া কাউন্টারটা এ্যাসট্রেতে গুঁজে দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল খোলা জানালার বাইরে। এক জোড়া তরুণ তরুণী প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে দূরে খোলা মাঠে। ওদের হাসির লহরী মৃদু কানে আসছে ঋর। চোখে আকাশ, মনে মৃদু দোলা, খুব দৌড়াচ্ছে ঋ। পিছনে ছুটছে অলক। ওদের হানিমুনের দ্বিতীয় দিন আজ। খুব খুব খুশি ঋ। অসম্ভব ভালো লাগা। মনে হচ্ছে সারাটি জীবন এভাবেই কেটে যাবে।

প্রায় একটা বছর গেল। ভালো লাগাটা চাল ডাল তেল নুনে অনেকটাই মলিন হয়েছে। আজকাল ঋ মাঝে মাঝে বসে বসে ভাবে, কেমন করে দিনগুলো এমন মলিন হয়ে যাচ্ছে। অলক কাজের চাপে ঋর সঙ্গে বিশেষ একটা কথা বলারই সময় পায় না। সবসময় খুব বিরক্ত থাকে। কথায় কথায় রেগে আগুন হয়ে যায়। রাত গুলো ও অনেক সময় একলাই কাটে। যখন অলক ল্যাপটপ রেখে শুতে আসে তখন প্রায় রাত শেষ হব হব। কখনো কখনো গভীর ঘুমের ঘোরেও ওর আবদার মেটাতে হয়। নিজের  ভালো লাগার কথা আজকাল ভাবতে ভুলে গেছে ঋ। সবার থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে রাখে। বিশেষ করে কারো চোখের দিকে তাকায় না ঋ, ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে।

একাকীত্ব দূর করতে ঋ ভাবলো একটা চাকরী বাকরী  করা যাক। সিভি, ডকুমেন্টের ফাইলটা নিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি বার করতে বললো। গাড়ির কাচটা একটু নামিয়ে দিয়ে সিটে এলিয়ে দিল শরীরটা। 

হঠাৎ ধর্ ফর্ করে উঠে বসলো ঋ। দরজার লক থেকে চাবিটা লক করার পর খুলে নিয়েছিলো?

ব্যাগ খুঁজে চাবিটা পেল না। ড্রাইভার কিরণ লক্ষ্য করছিল ব্যাপারটা। প্রশ্ন করলো, 'কিছু কি হারিয়েছে? ' 

ঋ চমকে তাকাতেই দেখলো সামনের আয়নায় দু'টি চোখ সোজা তার দিকে বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই ঋ চোখ নামিয়ে নিলো। ভিতরে কেমন যেন একটা মৃদু ভালো লাগার অনুভব হলো। অনেক দিন পর কেউ তার দিকে খেয়াল করেছে।

সমস্যাটার কথা বললো ঋ। কিরণ তৎক্ষণাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে স্পীডে উড়ে এলো দরজার সামনে। ঠিক তাই। চাবি ঝুলছে। নিজের প্রতি বিরক্ত হলো ঋ। নেমে চাবিটা খুলে নিলো। তক্ষুণি হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গিয়ে খুলে তিন টুকরো হয়ে গেল। কিরণ দৌড়ে এল। কুড়িয়ে নিয়ে লাগিয়ে অন করে দিলো। ফেরত দেবারসময় তার হাতটা ওর হাতে একটু ছোঁয়া লেগে গেলো অসাবধানতায়। সঙ্গে সঙ্গে কিরণ বলে উঠলো, 'আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।' ঋ ও অভ্যাস বশত বললো, 'ইটস্ ওকে।' ঋ কিন্তু নট ওকে। এক মুহূর্তের জন্য বিদ্যুৎ ছুঁয়ে গেছে সে। কেন এমন হলো? ঋ ভাবতে থাকে। 

ইন্টারভিউটা ভালোই হলো। তবে অনেক সময় লাগলো। খিদে পেয়েছে খুব। গাড়িতে উঠতেই কিরণ বললো, 'কোনো রেস্তোরাঁয় দাঁড় করাবো?' 

ঋ অবাক। কিরণ কেমন করে বুঝলো ঋর খিদে পেয়েছে? কতো রাতে তো না খেয়েই শুয়ে পরে। অলক খেয়ালই করে না। ওর অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে কিরণ বলে উঠলো, 'আসলে আপনার মুখটা খুব শুখনো দেখাচ্ছে। তাই ভাবলাম... ' 
ঋ বললো, 'আমার সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে। কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে চলুন।' 'ওকে ম্যাম।' 
'প্লিস্ কিরণ, আমাকে ম্যাম বলবেন না। ঋ বলতে পারেন।' কথাগুলো ঋ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো। আর মধ্যে অসম্ভব একটা ভালোলাগা কাজ করছে বহু দিন পর। কেন, ঋ তা বুঝতে পারছে। অনেক দিন পর মনে হচ্ছে তার কথা ও কেউ ভাবছে বা তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিরণ তাদের নতুন ড্রাইভার। পড়াশোনা জানা, গ্রাজুয়েট। গ্রাম থেকে শহরে চাকরী খুঁজতে এসেছে। যতোদিন না পায় এভাবেই কিছু টাকা পাঠাবে মাকে। শুনেছিল ঋ অলকের কাছে। একটা গ্রামের ছেলেকে নিযুক্ত করায় ঋ সামান্য আপত্তি করেছিল। এই কলকাতা শহরের হালচাল ছেলেটা বুঝবে কি? তাছাড়া রাস্তা ঘাট চেনার ও তো ব্যাপার আছে। অলক বলেছিল আজকাল মোবাইলে গুগল ম্যাপের দৌলতে আর কোনো অসুবিধা হয় না। কথাটা ঠিক। কিরণকে স্কুলের নামটা বলতেই ও মোবাইলে টাইপ করে মোবাইলটা উইন্ডস্ক্রিনে সেট করে দিল। ব্যাস, ইজি ম্যাপ। 

রেস্টুরেন্টে এসে ঋ কিরণকেও ডেকে নিলো। ও ইতস্ততঃ করছিলো। ঋ জোড় করল।একই টেবিলে দু'জনে বসলো। ঋ মানুষকে মানুষ ভাবে। পেশা দিয়ে মানুষ বিচারের অভ্যাস তার নেই। তবে কিরণ যে আর ম্যাম বলে না সম্বোধন করলেও ঋ বলে ডাকে নি, এটা ঋ খেয়াল করেছে। একটা রেসপেক্ট কিরণ রেখে চলেছে, একটু দূরত্বও।

আজকের দিনটা ঋ বহু দিন পর মনের মতো করে উপভোগ করেছে । বহু দিন পর তার খুব ভালো লাগছে। রাতে শুয়ে শুয়ে সারা দিনটার কথা আরো একবার ভাবলো। মুখে মৃদু হাসি লেগে আছে। ঋ ঘুমিয়ে পরলো। 

কয়েক দিন পর ফোনে জানানো হলো ঋ স্কুলের টিচারিটা পেয়ে গেছে। আনন্দে ঋ নেচে উঠলো। অনেক গুলো বাচ্চাকে নিয়ে দিনের অর্ধেকটা সময় কাটবে, এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে। ঋ পরদিন খুব সুন্দর করে সেজে রেডি হয়ে নিলো। কিরণকে বলা আছে। আজ তার জয়েনিং। একটু তাড়াতাড়িই যাবে আজ।কিরণের সঙ্গে টুকটাক এটা ওটা কথা বলতে বলতে কখন যে পৌঁছে গেলো টের ই পেলো না ঋ।

নতুন মিস্ কে বাচ্চারা খুব ভালো ভাবেই এ্যাকনসেপ্ট করেছে। ওদের সাথে একটু পড়া, একটু খেলা করতে করতে ঋ ও বাচ্চা হয়ে গেছে। স্কুল থেকে বেড়িয়ে যখন গাড়িতে এসে বসলো, কিরণ একদৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকে। ঋ গুছিয়ে বসতে বসতে সামনে হঠাৎ তাকিয়েই  কিরণের আবেশ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকাটা দেখতে পেলো। চোখে চোখ পড়তেই কিরণ হেসে বললো, 'আজ আপনাকে একদম বাচ্চাদের মতো খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে, প্রাণচঞ্চল, উদ্দাম নৃত্যরতো ময়ূরের মতো।' এই সেরেছে। কিরণ এসব কি বলে। কবিতা টবিতা লেখে নাকি! 

কিছুদিন পর কিরণের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। ওর বাড়ির সব কথা কিরণ শেয়ার করে ঋর সাথে। ঋ ও সব কথা বলে কিরণ কে। একসাথে রেস্টুরেন্টে ও খায়।  স্কুল শেষে বাড়ি ফিরতে বিশেষ ইচ্ছে করে না আর। সেই একা একা। তাই বেশির ভাগ দিনই কোথাও ঘুরতে চলে যায়।

দুইদিন হলো, কিরণ নেই। ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিরণ গ্রামে গেছে। অন্য ড্রাইভার এই কয় দিন ম্যানেজ করে দেবে। আর মন খারাপ লাগছে। এতো কেন? বুঝতে পারছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। দু'দিন ছুটি বলে যে কিরণ গেলো আজ পাঁচ দিন হলো, ও ফেরে নি। ফোনে ও পাচ্ছে না। নটরিচেবল্। ঋর শরীর খারাপ। স্কুলে যায় নি। মন ও খারাপ। শুয়ে আছে। কলিং বেল। দরজা খুলে চমকে গেলো, সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কিরণ। 'আজ স্কুলে যান নি কেন? গাড়ির চাবিটা দিন, পরিষ্কার করবো।' ঋর হঠাৎ কি যে হলো। কিরণের একটা হাত ধরে এক হেঁচকা টান দিয়ে ভিতরে টেনে নিয়েই তাকে ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কিরণ হতভম্ব হয়ে গেছে খানিকটা। কি করবে বুঝতে পারছে না। ঋ কেঁদে ফেলেছে। 'তুমি এতো দিন দেরি করলে কেনো, আমার কথা একটি বার ও কি মনে পড়ে নি? একটা, মাত্র একটা ফোন ও তো করতে পারতে। এতো নিষ্ঠুর কেমন করে হলে?' কিরণ এবার ঋকে আস্তে করে জড়িয়ে নিল। ঋ, মার খুব জ্বর ছিল, কমছিলো না কিছুতেই। তাই ফিরতে পারি নি। আর ফোনে তো টাওয়ারই থাকে না আমাদের ওখানে। কি করে করবো, বলো। লক্ষীটি, আর কেঁদো না, শান্ত হও, প্লিস।

ঋ এবার শান্ত হলো। কিরণ বাঁধন আলগা করে দিয়েছে। ঋ ও ছেড়ে দিলো, খানিকক্ষণ দু'জনেই চুপচাপ। তার পর কিরণ বললো, 'ঋ চাবিটা দাও। তুমি কি আজ আর বেড়োবে?' ঋ ওর চোখের দিকে তাকালো। শরীরে একটা ঝর্ণার অনুভূতি  । ঋ ফ্যাকাসে ভাবে হাসলো। 'না, আজ আর বার হবো না। আমি রেস্ট নেবো। তুমি গাড়ি ধুয়ে নাও ধীরে সুস্থে।' কিরণ চলে গেলো। ঋ ভাবতে লাগলো, এটা কি হলো। তার মনের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে গেলো যে। সর্বনাশ। ঋ বিবাহিতা, অথচ অন্য পুরুষের প্রতি মানসিক ও শারীরিক ভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে। সমাজ এ অনুমতি তো দেবে না। আর মনে অপরাধ বোধ কাজ করতে শুরু করেছে। প্রবল ভাবে ঋ কিরণ কে কাছে পেতে চাইছে। কিন্তু তার ভিতরের অপরাধ বোধ তাকে ঘৃণার চোখে তিরস্কার করছে। অসহায় লাগছে ঋর। কিরণ বোধহয় ঋর মন পড়তে পারে। ও কোনো বিশেষ কথা বলছে না আজকাল। দূরত্ব রাখছে।

ঋ একজন কাউন্সিলর এর কাছে এসেছে। তিনি কিছু ঘুমের ওষুধ আর এ্যাংজাইটি কমানোর ওষুধ দিলেন।ঋ এখন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। হাসি মজায় দিন গুলো ভালোই কাটছে। তবে বিশেষ অন্তরঙ্গতা একেবারেই নেই দুজনার মধ্যে। সেই দিনের সেই দুর্বল মুহূর্তটুকু যেনো আসে নি জীবনে। ভালোই চলছে সব। কিন্তু অলকের সঙ্গে তিক্ততা বাড়ছে দিন দিন। আজ অলক চারদিনের জন্য বাইরে যাবে। পরশু থেকে মনোমালিন্য চলছে। বেড়োবার আগে ঋ অলককে কাছে টেনে মান ভাঙাতে চাইলো। অলক উল্টো আরো রেগে গিয়ে বলে বসলো, 'তোমাকে আমার আর সহ্য হয় না, তুমি মরতে পারো না?' বলে চলে গেলো অলক। পিছন ফিরে দেখলো না ঋর মুখে এখন কালবৈশাখীর মেঘ। ঋ দরজা বন্ধ করলো। একমাসের জন্য কেনা ঘুমের ওষুধ একটা গ্লাসে নিয়ে জল নিলো। তারপর খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো। আঃ কি শান্তি। জীবন খুব কষ্টের। মৃত্যু কতো শান্ত, সুন্দর।

দরজার লক ভেঙে কিরণ ঢুকেছে ডেকে ডেকে সারা না পেয়ে। ওষুধের খালি পাতা গুলো থেকে অনুমান করতে পেরেছে ব্যাপারটা। ঋকে তেঁতুল জল খাইয়ে বমি করিয়েছে তিন বার। ঋ ঘুমোচ্ছে। ভিজে রুমাল দিয়ে পরম যত্নে চোখ মুখ বার বার মুছিয়ে দিচ্ছে কিরণ। পর দিন সকালে ঋ চোখ খুলে দেখলো ওর বিছানায় পাশেই একটা চেয়ারে বসে আছে কিরণ। চোখ টেনে ভালো করে খুলতেই কিরণ ওর দিকে তাকালো। ঋর চোখ দিয়ে অঝরে জল পড়ছে। কিরণ মুছিয়ে দিয়ে বললো, 'কেঁদো না লক্ষীটি, আমি তো আছি।' ঋ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। কিরণ একহাতে ঋকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতটা মাথায় বোলাতে থাকলো। তার পর ঠোঁট দিয়ে ধীরে ধীরে শুষে নিলো ঋর সমস্ত কষ্ট গুলোকে। চুলে আঙুল বুলিয়ে ঋকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিলো। দু'দিন টানা জেগে থাকার পর আর কিরণ পারলো না চেয়ারে বসে ঋর কোমরের পাশে বিছানায় মাথাটা রেখে ঘুমিয়ে পরলো। চার ঘণ্টা ঘুমানোর পর ঋ উঠে দেখলো কিরণ তখনো ঘুমাচ্ছে। ঋ একটা সিগারেট ধরালো। অলকের ফেলে যাওয়া প্যাকেট। জানালা দিয়ে ছেলে মেয়ে দুটো কে দেখতে দেখতে ঋ মনস্থির করে ফেললো, কাল ই ডিভোর্স টা ফাইল করে দেবে। তেল নুন সম্পর্ক আর চাই না। কিরণের মতো বন্ধু থাকলে তার আর ভয় কি।

Comments

  • No Comments
Log Out?

Are you sure you want to log out?